শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলায় অনেক কৃষক গাভি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। গাভি পালনকারী খামারীরা গাভির বর্জ সংরক্ষণের কৌশল না জানায় বর্জ যেখানে সেখানে ফেলে দিয়ে পরিবেশ দূষণ করে। আজকে সেই গ্রামের নারীরা এসডিএস-এর সমম্বিত কৃষি ইউনিটের সহযোগিতায় গাভির বর্জ ব্যবহার করে ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে সংসারের কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তাদের কাছ হতে জানা যায়, ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার একটি উন্নতমানের জৈব সার। উৎকৃষ্টমানের জৈব সার হওয়ায় জমিতে ব্যবহারের ফলে ফলন অনেক ভালো হয় এবং ফসলে রোগ-জীবানু অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম হয়। পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় নিরাপদ সবজি  উৎপাদনে ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার ব্যবহার ব্যাপক ভুমিকা রাখছে। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির এবং জৈব বালাইনাশক হিসেবে ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্লান্ট-এর অবদান অনেক। কৃষকরা নিজের জমিতে ব্যবহারের পাশাপাশি অতিরিক্ত জৈব সার বাজারে বিক্রি করে। প্রতি ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্লান্ট হতে ৪৫-৫০ দিনে প্রায় ৯-১০ মন সার উৎপাদন হয়। এই সার ৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে প্রায় ৩৬০০-৪০০০ টাকা আয় করে। বিকে নগর ইউনিয়নের মৃধাকান্দি গ্রামের ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার উৎপাদনকারী রিজিয়া বেগম বলেন, আগে আমরা গরুর গোবর দিয়ে মুঠা বানাইতাম এবং অতিরিক্ত গোবর গরুর গোয়াল ঘরের পিছনে ফেলে দিতাম। এসডিএস-এর কৃষি অফিসার গোবর দিয়ে ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার তৈরীর জন্য বলেন। স্যারের পরামর্শ মোতাবেক এসডিএস-এর নিকট প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা জৈব সার তৈরী শুরু করি। এই সার বাজারে বিক্রি করে আমি বছরে প্রায় ২০০০০-২৪০০০ টাকা আয় করছি। এতে আমি আমার সন্তানের লেখাপড়ার খরচসহ অন্যান্য কাজে এই টাকা ব্যয় করতে পারছি। আমার স্বামী এতে অনেক খুশি। ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্রস্তুতি বিষয়ে মহিউদ্দীন হাজী কান্দী গ্রামের কৃষাণী হালিমন বেগম বলেন,২০২০ সালে এসডিএস-এর দেওয়া ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে ৪ হাত বাই ২ হাত মাপের দুইটি চেম্বার তৈরী করি এবং চেস্বারের নিচে দুটি ছিদ্র করি। চেম্বারে পাশে গোবর, কচুরীপানা, ভুষি, কাঠের গুরা, মুরগীর বিষ্ঠা, ছাই, বাড়ির পচনশীল উচিষ্ঠাংশ  ইত্যাদি স্তুপ আকারে জড়ো করি। একটি বালতিতে  ১২ লিটার পানির মধ্যে ১০০ গ্রাম ট্রাইকো-কম্পোস্ট পাউডার, ৪ কেজি খৈল, ৪ কেজি চিটাগুড় মিশ্রিত করে লেই তৈরী করি। চেম্বারে স্তুপ হতে ৮ ইন্ঞি সম পরিমান বর্জ নেই।  ৫ কেজি লেই এ ৫ লিটার পানি দিয়ে পাতলা করে মিশ্রন তৈরী করি। এই মিশ্রিত পানি চেম্বারের ৮ ইন্ঞি স্তুপে ছিটিয়ে দেই। পরে স্তুপ কোদাল দিয়ে ভালোভাবে উলট-পালট করে দেই। এভাবে ৮ ইন্হি পর পর স্তুপ তৈরী করে চেম্বারটি পূর্ণ করে উপড়ে পাটের ছালা বিছিয়ে দেই। আবার সপ্তাহে সপ্তাহে চেম্বারের  মিশ্রন উলট-পালট করি। এভাবে দেখা যায় ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে জৈব সার তৈরী হয়। ২০ দিন পর হতে চেম্বারের নিচের ছিদ্র দিয়ে সে কালো পানি বের হয় তা আমরা জমিতে স্প্রের মাধ্যমে ব্যবহার করি। এই মিশ্রনটি ভিটামিনের মতো কাজ করে। এসডিএস এর কৃষি কর্মকর্তা জনাব খাজি আলম বলেন, এসডিএস-এর সহযোগিতায় এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর অর্থায়নে সমম্বিত কৃষি ইউনিটের আওতায় ২০১৭ সাল হতে মাটির গুণাগুণ রক্ষায় ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার উৎপাদন নিয়ে কাজ করে আসছি। এ সার উৎপাদনের জন্য আমরা কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া সহা বিনামূল্যে কৃষকদের ইট, বালু সিমেন্ট সরবরাহ করি। ট্রাইকো-কম্পোস্ট সারের মূল উপাদান হিসেবে ট্রাইকোডার্মা পাউডার ব্যবহার করা হয়। ট্রাইকোডার্মা মূলত মাটিতে মুক্তভাবে বসবাসকারী একটি উপকারী অনুজীব ছত্রাক। এটি মাটিতে বসবাসকারী ক্ষতিকর জীবাণু যেমন ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও নেমাটোড মেরে ফেলে এবং পচনক্রিয়া ত্বরাম্বিত করে। ফলে এ জৈব সার মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করে, মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় সাহায্য করে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা কমাতে সাহায্য করে, মাটির অম্লত ও পিএইচ মানের ভারসাম্য আনে, মাটির পানি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সহ অনেক উপকার করে। জাজিরা উপজেলায় ৩০ টি ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্লান্ট হতে নিয়মিত সার উৎপাদন হচ্ছে। বাজারেও এ সারের ব্যাপক চাহিদা তৈরী হয়েছে। মূলনা ইউনিয়নের সবজি চাষি বাবু শরীফ বলেন, আমি সারের দোকান হতে এসডিএস-এর খামারীর উৎপাদিত ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার শসা ক্ষেতে ব্যবহার করি। আমার শসার চারায় কোন গড়া পচা রোগ হয় নাই কিন্তু আমার পাশের ক্ষেতের শসা গোড়া পচা রোগ হয়ে অনেক গাছ মারা গেছে। এই সার ব্যবহারে গাছরের রোগ অনেক কম হয়েছে এবং গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের এলাকার কৃষক ট্রাইকো-কম্পোস্ট জৈব সার ছাড়া অন্য কোন কোম্পানির জৈব সার ব্যবহার করে না। সার বিক্রয়কারী ফারুক কাজি বলেন, কৃষক পর্যায় এ সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমি প্রতি মাসে প্রায় ৫০-৬০ মন ট্রাইকো-কম্পোস্ট সার বিক্রি করি। তবে সমস্যা হচ্ছে সারের চাহিদা অনুযায়ী এ সার উৎপাদনকারী যোগান দিতে পারেনা। জৈব কৃষির একটি প্রধান উৎস হতে চলেছে ট্রাইকো-কম্পোস্ট জৈব সার। ছত্রাকনাশক দমনে ট্রাইকো-কম্পোস্ট হতে  পাওয়া তরল লিচেট কার্যকরী ভুমিকা পালন করছে। আবার এ সার ব্যবহারে জমিতে রাসায়নিক সারের পরিমানও কম লাগছে। গরুর বর্জ ব্যবহার করে গ্রামের গৃহিনীর আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠছে ট্রাইকো-কম্পোস্ট উৎপাদন। ধীরে ধীরে পরিবেশ বান্ধব নিরাপদ সবজি উৎপাদনে ট্রাইকো-কম্পোস্ট সারের ব্যবহার সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরবে বলে আশা করা যায়।

 

 

Pin It on Pinterest